বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২১ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
দেনমোহরের পরিমাণ যত বেশি হোক না কেন, স্বামী তা সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। এমনকি স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত দেনমোহরানার দায় হতে স্বামীকে মুক্তি দেবে না। যদি স্বামীর উত্তরাধিকারীরা স্বামীর সম্পত্তি থেকে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন তাহলে স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারবেন। উল্লেখ্য, যদি স্বামীর আগে স্ত্রীর মৃত্যু হয় এবং স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধিত না হয়ে থাকে তাহলে স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা ওই দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী।
দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। ‘সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবি করতে পারে এবং স্বামী পরিশোধে ব্যর্থ হলে স্ত্রী সহবাসে যেতে অস্বীকার করতে পারেন।’ (মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ ২১ ডি.এল.আর)। এ অজুহাতে স্বামী স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করলেও দেনমোহর পরিশোধে বাধ্য। (১১ ডি. এল. আর. পৃষ্ঠা ১২৪)।
বিয়ের সময় দেনমোহর কত হবে তা নির্ণয়কালে স্ত্রীর পিতার পরিবারের অন্যান্য মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে যেমন স্ত্রীর বোন, খালা, ফুফুদের ক্ষেত্রে দেনমোহরের পরিমাণ কত ছিল তা বিবেচনা করতে হয়। (হামিরা বিবি বনাম যুবাইদা বিবি, ১৯১৬, ৪৩ আই. এ. পৃষ্ঠা, ২৯৪)। তাছাড়া স্ত্রীর পিতার আর্থ-সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত যোগ্যতা, বংশ মর্যাদা, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদির ভিত্তিতে দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। অপর দিকে বরের আর্থিক ক্ষমতার দিকটাও বিবেচনায় রাখা হয়। এসব দিক বিচার বিবেচনা করেই মূলতঃ দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়। উল্লেখ্য, দেনমোহর একবার নির্ধারণ করার পর এর পরিমাণ কমানো যায় না, তবে স্বামী ইচ্ছা করলে তা বাড়াতে পারেন। (জহুরান বিবি বনাম সোলেমান খান, ১৯৩৩, ৫৮ ক্যাল.জে. পৃষ্ঠা, ২৫১)। তবে দেনমোহর বিয়ের পূর্বে, বিয়ের সময় এমনকি বিয়ের পর নির্ধারণ করা যেতে পারে। (কামরুন্নেসা বনাম হুসাইনি বিবি, ১৮৮০, ৩ অল. পৃষ্ঠা, ২৬৬)। কিন্তু নির্ধারিত দেনমোহরের পরিমাণ কোন ক্রমেই দশ দিরহামের কম হবে না। (সাহাবুদ্দিন বনাম উমাতুর রসুল, ৬০, এপি, পৃষ্ঠা-৫১১)। স্ত্রী দেনমোহরের দাবীতে মামলা করলে, দেনমোহরের পরিমান বেশী বা স্বামীর সামর্থ্যরে উর্ধ্বে এরুপ কথা স্বামীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অজুহাত হিসেবে গ্রাহ্য হবে না। (সুলতান বেগম বনাম সায়াজ উদ্দিন, ১৯৩৬, ১৬১ আইসি. পৃষ্ঠা, ৩০০)। মোদ্দা কথা হলো, কোনো বিবাহে দেনমোহর ধার্য্য না হয়ে থাকলেও স্ত্রী মর্যাদা মাফিক দেনমোহর পাওয়ার অধিকারিণী। (২০ ডিএলআর, পৃষ্ঠা, ২৭)।
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ এর ১৬ (৩বি) ধারার বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে ডিক্রিজারী আদালত দেনমোহরের টাকা কিস্তিতে পরিশোধের আদেশ দিলে পরবর্তী কিস্তির টাকা পরিশোধে ব্যর্থতার জন্য আবারও সিভিল কারাদন্ডের নির্দেশ দিতে পারে। (মাকসুদা আক্তার বনাম মোঃ সেরাজুল ইসলাম, ৫ বিএলসি (২০০০), ৫৯৫]। তবে এ কারাদন্ডের আদেশ আংশিক বকেয়া টাকার জন্য দেনাদারকে উর্ধ্বে তিন মাস বা টাকা পরিশোধ পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত করতে পারেন।
তবে স্ত্রী কিন্তু দেনমোহর মাফ করতে পারে। তবে মাফ করার সময় স্ত্রীর পূর্ণ সম্মতি থাকতে হবে। একই সাথে তাকে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে, কোন রকম প্ররোচনা ছাড়া মুক্তমনে দেনমোহর মাফ করতে হবে। (ফায়ানী বেগম বনাম ওমরাভ বেগম, ১৯০৮, ৩২ বম. পৃষ্ঠা, ৬১২)। তবে পাকিস্তান ল ডাইজেস্ট (১৯৫৯) লাহোর এর ৭১০ পৃষ্ঠায় সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে স্ত্রীকে মোহরানা দেয়া হয়েছে কিনা যিনি তা পরিশোধ করেছেন তাকেই তা প্রমান করতে হবে। স্ত্রী যদি স্বামীকে আগে তালাক দেন, সে ক্ষেত্রেও অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রী যিনিই তালাক দিন না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তবে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন মিলন না হয়ে থাকলে হলে কিংবা যৌন মিলনের আগেই স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী অর্ধেক পরিমান দেনমোহর পেতে অধিকারিণী। (তাজবি বনাম নাতার শেরীফ, ১৯৪০, ২ এম.এল. জে. পৃষ্ঠা, ৩৪৫)।
দেনমোহর দুই প্রকার। একটি তাৎক্ষণিক দেনমোহর, যা স্ত্রীর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর। বিলম্বিত দেনমোহর বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া স্বামী ১ম স্ত্রী অর্থাৎ সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। সাধারণত দেনমোহরের কিছু পরিমাণ বিয়ের সময় তাৎক্ষণিক দেনমোহর হিসেবে দেওয়া হয় এবং তা কাবিননামায় লিখিত থাকে। বাকিটা বিলম্বিত দেনমোহর হিসেবে ধরা হয়। বিয়ের সময়ে দেয়া শাড়ী, গয়না ইত্যাদি কখনো দেনমোহরের অংশ হিসাবে বিবেচিত হবেনা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুল বলা যাবে না। (আঃ কাদের বনাম সালিমা, ১৮৮৬, ৮ অল. পৃষ্ঠা-১৪৯)। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে স্ত্রী তাঁর দেনমোহর আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করে তা আদায় করতে পারেন। তবে অবশ্যই তালাক হওয়ার তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। এর জন্য মাত্র পঁচিশ টাকা কোর্ট ফি দিতে হয়।
স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী সমুদয় অথবা শুধুমাত্র বিলম্বিত দেনমোহরের অর্থ অনাদায়ী থেকে থাকে। তবে স্ত্রী তার প্রয়াত স্বামীর ভূ-সম্পত্তি দখল করত উহার রাজস্ব বা মুনাফা হতে তা উসুল করতে পারে। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ, ১৮৭১, ১৪ এম.আই. এ. পৃষ্ঠা-৩৭৭)। দেনমোহরের দাবীতে কোন বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি দখল করে থাকলে যদি তাকে অন্যায়ভাবে সেই সম্পত্তি হতে বেদখল করা হয়, তবে সে দখল পূণরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। (মজিদ মিয়া বনাম বিবি সাহেব (১৯১৬) ৪০ বম. পৃষ্ঠা-৩৪)। তবে দেনমোহরের জন্য বিধবা স্ত্রী স্বামীর ত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে থাকলে সেই সম্পত্তিতে প্রাপ্ত মুনাফা সম্পর্কে স্বামীর অন্যান্য ওয়ারেশদের হিসেব দেয়া বিধবার দায়িত্ব। (বিবি বাচান বনাম শেখ হামিদ (১৮৭১) ১৪ এম.আই.এ. পৃষ্ঠা ৩৭৭)।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, আইন গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮